বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের সম্ভাবনাময় দেশ। এদেশের মানুষের প্রথম এবং প্রধান আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের আয়। কৃষিকাজ বা অন্যান্য পেশাজীবিরাও এই খাতের আয়কেই প্রাধান্যতা দিয়ে থাকেন। বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় মুল অংশই আসে এই খাত থেকে। সরকারী বেসরকারী সবাই পজেটিভ দৃষ্টিতে এই খাতের উন্নয়ন করতেই প্রস্তুত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে। তার কারন গুনগত মান আর অল্প দাম। তৈরী পোশাকের বাজার দিন দিন যেমন বাড়ছে তেমনি বিভিন্ন দেশের ক্লায়েণ্টরা এদেশে এসে খুঁজে পাচ্ছে এক অযত্ন আর অবহেলায় নির্মিত একটি বড় খাত। একে আরো বেশি শক্তিশালী করা যায় । সেটা হয়ত অনেকেই বুঝতে পারেন অথচ যেমন ছিলো তেমনই পড়ে থাকে। এর অন্যতম কারন জানাশোনার অভাব। পোশাকের কোয়ালিটি বা মান নির্ভর করে তা প্রদর্শনের উপর। আসুন আমরা আরো জানার চেষ্টা করি কিভাবে তৈরি পোশাক খাতকে দক্ষ করা যেতে পারে!
চর্চাসহ নথিভুক্তিকরনঃ সোজা কথায় ডকুমেন্টেশন এর সাথে চর্চা করা। আমাদের দেশের বেশিরভাগ কারখানায় দেখা যায় সব তথ্য সাজানো গোছানো অবস্থায় রেখে দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন হিসেব ছাড়া। কিংবা আলাদা খাতায় লিপিবদ্ধ কোন পদ্ধতিতে। এসব করা হয় সাধারনত কতগুলো কারনে। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে শ্রমিকদের খাটানো তার মধ্যে একটি কারন। ওভার টাইমিং এ দেশে কোন নিয়ম মেনে চলে না। চলে শুধু প্রোডাকশন। মালিকেরা চায় ডিম দেয়া হাঁসের সব ডিম একরাতে ঘরে নিতে। ফ্যাসাদ এখানেই। আবার অনেকেই গুরুত্ব দেননা ডকুমেন্টেশন বা নথিভুক্তিকরন কাজকে। মুলত কাজ করার প্রথম এবং প্রধান শুরুই হওয়া উচিত ছিলো নথিভুক্তির মধ্য দিয়ে। নথিভুক্তির অবহেলা কিভাবে ধরা পড়ে তার কয়েকটি উদাহরন দিই- বেশিরভাগ কারখানায় অডিট করার সময় সামান্য মেশিন নিডেল/ বা সুঁচ এর হিসাব দেখাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যায় ম্যানেজমেন্ট সহ সেখানকার কর্মকর্তারা। এটা ছাড়াও প্রতিদিনের সমস্যা কিংবা সমাধানের নেই কোন রেকর্ড। এসবে কর্মকর্তারা ভাবেন সময় এবং উৎপাদনের ক্ষতি হয়। আসলে এসব না করায় কারখানার কাজের প্রতি অন্য কোন কাষ্টমারের আস্থা থাকে না।
কিভাবে ইনফো এ লিখুন লেখক হয়ে সবাইকে কিছু তথ্য জানান
লেখালেখি করে আপনি জিততে পারেন আকর্ষনীয় পুরষ্কার! বিস্তারিত দেখুন
প্রশিক্ষন ঃ এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। প্রশিক্ষন কাকে বলে এটা এদেশে নেই। প্রশিক্ষন নিতে হবে? তো নাও বাইরে গিয়ে নিজের টাকায় কিংবা ছুটির দিনে করো। কেউ কাজ পারছে না, তাকে ছাঁটাই করে দেয়া হচ্ছে। তাৎক্ষনিকভাবে। অথচ তাকে একবার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। মানবতা বিরোধীও বটে এরকম আচরন। তবু শিল্পায়নের এই সময়ে বাংলাদেশে কেউ একে পরোয়া করে না। সারাদিন সবাই গার্মেন্ট লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে কাজ আর কাজ চাই, কিন্তু সামান্য প্রশিক্ষন যে অটোমেটিক কিছু বেশি উৎপাদন দিতে পারে তা কারো মগজে নেই। যে কর্মীর আজকের উৎপাদন ৫০ পিস সে কর্মীর কাছে গিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে আরো কয়েক পিস হয়ত আদায় করা যাবে কিন্তু তাকে প্রশিক্ষন দিলে এবং সেটা মাসে বা ত্রৈমাসে হলে যে পরিমান উৎপাদন হবে তা ঐ কয়েক পিসের কাছে কিছুই নয়। প্রোডাক্টিভিটি বা উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে এরকম কারখানার সংখ্যা হাতে গোনা। অথচ আমাদের দেশের প্রথম এবং প্রধান রপ্তানী আয় গার্মেন্ট শিল্প। কিভাবে প্রশিক্ষন দেয়া যেতে পারে? এটা আসলেই একটা সময় সাপেক্ষ প্রশ্ন এবং এখানে দরকার সুস্থ্য মানষিকতার। শ্রম শিল্পকে সম্পদ হিসেবে চিন্তা করে এগোনোটাই হবে সঠিক কাজ।
উৎপাদনশীলতা পর্যবেক্ষনঃ ২০০৯ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট কর্মীদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৭৭ শতাংশ। কিন্তু এটা শুধুমাত্র বেসিক কিছু প্রোডাক্টের জন্য প্রযোজ্য। যেখানে অন্যান্য দেশের উৎপাদন ক্ষমতা এর চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে চায়না ১০০ভাগ। পাকিস্তান ভারত এরাও অনেক গুন এগিয়ে আছে শুধু আমাদের দক্ষতা থেকে। অনেকের মতে এদেশের কর্মীর দক্ষতা মাত্র ৪৫% যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এ ক্ষেত্রে সবাই একমত যে শুধু অল্প মজুরী হবার কারনেই আমাদের বানিজ্য বৃদ্ধি হচ্ছে আর আমরা এ দিয়েই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবো তা এখন আর যুক্তিযুক্ত নয় । এখন ওপেন চ্যালেঞ্জ চলে এসেছে, ক্রেতারা সময় আর মুল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য দেখতে চান সেই সাথে পন্যের মান। মান যদি খারাপ হয় তবে সব কিছুই বৃথা। এক বারের জন্য যে ক্রেতা খারাপ মানের প্রোডাক্ট পেয়ে যাবে সে আর কোন দিন ভালবেসে সে কোম্পানীর কাছে আসবে বলে আশা করাটাও বোকামী। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কর্মীদের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা সচেতনতা, কর্ম পদ্ধতি নির্বাচন এবং উন্নত প্রশিক্ষন। এসব করা গেলেই হয়ত কাংক্ষিত মানের উৎপাদন আশা করা যাবে।
মান নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থাঃ ইংরেজিতে কিংবা কারখানায় প্রচলিত শব্দের নাম কিউ সি(QC)। অনেক জায়গায় আছে আর, কিউ, সি। মানে কোয়ালিটি কন্ট্রোল বার রিকোয়ার্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল। এসব নামে শ্রমিকদের পদবীও আছে। কিভাবে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় মান নিয়ন্ত্রন হয় তা বলা হাস্যকর। তাই এসব তথ্য এখন বিদেশীদের কাছেও হাসির খোরাক। সবাই জানে কারখানা মালিক কিউ,সি বিভাগ রেখেছে শুধু কাষ্টমারকে দেখানোর জন্য। আদতে এখানে সঠিক মান নিয়ন্ত্রন তো দুরের কথা কিছুই হয় না। অনেক কারখানার কিউ, সি ম্যানেজার সারাদিন ব্যয় করেন বিভিন্ন বায়িং অফিসের কিউ,সি দের সাথে গল্প, আড্ডা কিংবা হুকুম তালিম করে। আবার অনেকেই প্রোডাক্ট ইন্সপেকশন কালে ইন্সপেক্টরের কাছে নানারকমের রিকোয়েষ্ট করে দিন পার করেন। এই হচ্ছে বর্তমান কিউ সি। মান নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থা এত খারাপ হবার দরুন কোন ক্রেতাই আর বিশ্বাস রাখেন না কারখানার উপরে। তারা নিজেরাই পন্যের গুনাগুন দেখেন, পরীক্ষা করেন এবং সব শেষে বিক্রয় যোগ্য মনে হলে পন্য গ্রহন করেন। এখানে আমাদের দেশের সকল কারখানার চিত্র এক না হলেও অধিকাংশ চিত্র একই রকমের। সবাই আড়ালে ক্রেতাকে ঠকানোর অনেক চেষ্টা করেন। তাই এই জায়গাটাতেও বিশ্বস্ততা নেই কারোরই। যদি কেউ কারখানার উন্নয়নের পাশাপাশি ক্রেতার বিশ্বস্ততা অর্জন করতে চান তবে অবশ্যই মান নিয়ন্ত্রনে ক্রেতার ক্রয় পদ্ধতি অনুসরন করবেন। একে বলা হয় ম্যানুয়াল, প্রত্যেক ক্রেতার আলাদা ম্যানুয়াল আছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ যে সেই ম্যানুয়াল পড়েও দেখেনা এটাও জানা আছে ক্রেতার। তবু তারা দিয়ে রাখে। কারন সময়মত নিজের অধিকার আদায়ে সেই ম্যানুয়াল তাদের সাহায্য করে।
এছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে যা আমাদের গার্মেন্ট শিল্পকে করে রেখেছে কুঁড়ে আর নিম্ন মানে। আমাদের জন্য অবশ্যই এটা একটি হুমকি যা আমরা অনেকেই এখনো ভাবছি না। গার্মেন্ট শিল্প একটা বাড়তি ব্যাবস্থা যা আমাদের জন্য অবশ্যই সৌভাগ্যের হয়ে উঠছে দিন দিন। কিন্তু এমন মনে করার কোন কারন নেই যে আমাদের দেশে মূল্য কম তাই ক্রেতা হন্যে হয়ে এদেশেই আসবে। এখন আমাদের চেয়েও কম মূল্যের দেশ আছে, ইথিওপিয়া কিংবা আফ্রিকা হচ্ছে তার উদাহরন। যদি এমন হয় যে সব শিল্প সেদিকে শিফট হয়ে যায় তবে আংগুল চোষা ছাড়া আর কোন বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।
মন্তব্যসমূহ